Saturday 16 February 2008

অতৃপ্ত জনরোষ প্রায়শ আত্মকলহে মাতে

বিগতযৌবনা গণবনিতার মতো ক্লান্ত নিরীহ ছিল সেই গাছ বনতলী ঘেঁষে, যুক্ত যা করেছে সে প্রতিবেশে, কখনো হয় নি তার মাপজোক ঢাকে-ঢোলে, পাতায় ফুলে ও ফলে, কাণ্ডে ও মূলে ছাড়া

যে পাখি এসেছে যখন, ফেরায় নি কাউকে কখনো, ঢেরগান প্রযোজিত পান্থপাদপে, নিহিত ভূগোলে, শ্যামে কী কৃষ্ণে নিজ কাণ্ডকলাপে

ছায়ার মায়ায় বেঁধেছে সে বহুজনে, টেনেছে দূরের পাখি, ফড়িং ও মৌমাছি দারুবনতটে

একটা ফুল তার ছুড়েছে কামনাধনুকে তীর
একটা ফল তার ডেকেছে মৃত্যুকে বাড়িতে
একটা পাতা তার গেছে কুঞ্ঝটিকার দিকে
একটা কাণ্ড তার এনেছে সত্যের মহামারি
একটা মূল তার দিয়েছে ভূকম্পনের ভীতি

মাত্র এ পঞ্চদোষে পাড়া-প্রতিবেশী যত মরু ও জলাশয়, পথ ও টিলা-ট্যাঙ্গর, পাহাড় ও গাছপালা, ভূমি ও ঘরবাড়ি ঠুকেছে গাছের নামে পোক্ত নালিশ-- সমাজ নেই এর, এরে একঘরে কর, ফুলে যৌনতা ও ফলে বিষ, পাতার রেখায় এর পাপ লেখা আছে, কাণ্ডে মিথ্যা ও মূলে এর বিনাশমন্ত্র গাঁথা, এরে সমাজচ্যুত কর, কর সাষ্টাঙ্গে নির্মূল

ঘোর বৃষ্টিকে ডেকে আনা হয়-- গাছ তেমনি থাকে
আসে অগ্নিরোদ-- গাছ যেমন তেমন
বজ্র আসে-- কিছুই হয় না গাছের

ক্রমে করাতি প্রস্তুত, ক্রমে পাকানো হয় রশি, সাজ সাজ রব পড়ে পাড়ায়, হৈচৈ-এ জেগে ওঠে জলমীনতক, রাত না ফুরাতে

ভোরে, প্রান্তরে ভেঙে পড়ে পাড়া, পাড়ার গড় চোখ দেখে যে গাছটি আপনা থেকেই নুয়েছে ভূতলে, মানে সে বরণ করেছে ইচ্ছামৃত্যুরে, ফলে হতাশায় জনতা নির্বাক, ফলে বেদনায় বিমূঢ় আক্রোশ

অথচ জনরোষ চেয়েছে দিতে গাছটিকে উচিত শিক্ষা, চেয়েছে তড়িঘড়ি তজ্জাত রোষের দমন

অতৃপ্ত জনরোষমালা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শেষে হানতে আরম্ভ করে নিজেরা নিজেকে, এ ওর কণ্ঠায় বসায় মারণ কামড় তো ও মটকে দেয় এর নিশপিশে হাত

আত্মপক্ষ সমর্থনের মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ থাকাটাই স্ব-মূল্যায়নের সবচে’ বড়ো সীমাবদ্ধতা

বয়সানুপাতে এক্সপোজড কাজবাজ এত কম কেন ? এ কথা ভাবতে গেলেই বাইশ সংখ্যাটা খুব মনে পড়ে, আসলে একুশ, লোকজন কেন যে একুশ-আঙুলেদের মিছে বাইশ-আঙুলে বলে ডাকে, আগে কখনো তা ভেবেও দেখি নি, বলতেন তিনি, শুয়ে কখনো অঙ্ক কষবি না দোহাই, অথচ তাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন হয়েও, শুয়ে শুয়ে ভেবে, তুচ্ছ এ কবিজীবনের আমি, ১১টা ৫৮ প্রায় বাজিয়ে ফেলেছি, এবার আমার, কী বলো, নিশ্চয়ই ফেরা দরকার কোনো টেবিলের দিকে

‘বয়স কেবল সময় দিয়েই বাড়ে’-- এরকম এক বিকলাঙ্গ সত্যের সাথে আমরা বিনাবাক্যব্যয়ে বহুদিন সংসার করে যাচ্ছি, এবার ওকে জানান দেয়া দরকার যে ভ্যালিড আরো ফ্যাক্টর আছে, বয়স কত হলে এক্সপোজার কত চাই, এরও অবশ্য কোনো মানদণ্ড নেই, সর্বজনগ্রাহ্য, নানা মত ও ভাবকে আমলে নিয়ে আমরা গণতন্ত্রের ঢেকুর সামলাতে ভিতর দিক থেকে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে শিল্পসুনাম প্রযোজিত মানুষ এবং মানুষ প্রযোজিত শিল্পসুনামের মধ্যে কোনটি বেশি অর্থবহ শিল্পীর জীবনে, মত স্থির করতে করতে সে সিদ্ধান্তে, বেলা বেশ বেড়ে যায়

ভাষাটাই বড়ো ব্যর্থতা ব্যর্থ লেখকের, সব বলবার কথা ধরা দেয় না সব ভাষায়, এ কথা যে যত আগে বোঝে, সে তত পথ হাঁটে দাপটের সাথে, বেশি মশলায় কষানো অখাদ্যের সামনে একবারও পড়ে নি, এমন মানুষের সাথে আমার মোলাকাত এখনো বাকিই রয়ে গেল, আভরণের অতি ঘটা নারীকে প্রায়ই খুব কৃত্রিম ও অসুন্দর করে তোলে, কবিতাকেও, জনৈক নারী-কলিগের বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে একবার ঢুকে পড়েছিলাম আমি ভুল কমিউনে, উদ্ভট সব সাজগোজের ভিতর থেকে ওকে খুঁজে-পেতে শেষে একটি রোস্টাহারের সময়ও আর বাঁচাতে পারি নি, আমাদের মধ্যে যারা ভেবেছে যে এক কলমে সারাজীবন লিখে যাবে, তাদের সঙ্গে মদীয় অভিজ্ঞতার খুব একটা মিল নেই, কলমকে প্রায়শই বদলানো লাগে, ভিন্ন শৈলীর দিকে মুখ করা, তাইজন্যে চমৎকার দেখতে এক কলমদানিও লাগে, অসংখ্য অপশনের একটি প্রতীকী উৎসরূপে

আমার লেখার ইচ্ছেগুলো, জানাবোঝার ইচ্ছের কাছে হারতে হারতে, মাঝে মাঝে সশব্দে দাঁত কিড়মিড় করে, বুঝেও সব আমি বলি না কিছুই, জানি যে কাউকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়া তার অধিকারে বাঁ’হাত, দেখার ইচ্ছেটা যেদিন হাঁসফাঁস করবে ক্লান্তিতে, কব্জিতে জোর থাকলে সেদিন, লেখার ইচ্ছেটা করতে পারে যা খুশি তাই, দু’য়ে মিলে এক হয়ে থাকাটাই সঙ্গত, এটাও এক দাম্পত্য ধরন, তবে প্রচলিত জায়া-পতি ধারণা এখানে নেই, একের খবর অন্যে নেয়া জরুরি খুব, বাট ডমিনেশন নট এলাউড, গৃহ-সহিংসতার কোনো বালাই নেই, একত্রবাস ফুটফুটে সব পোলাপান দেয়, দেয়ও না কখনো, এক বা দু’পক্ষেরই যদি সমস্যা থাকে, নিষেকোচিত

ফের যেদিন শুরু করলাম, সেটা বহুদিন পরে ভিতরের টানে, বাইরের চাপ ছিল বদার করি নি, যেসব বন্ধু ব্রাহ্মণের পৈতা পরে বাঁশের মাচাঙে বসে গ্রহদের উত্থান-পতন দেখছে খালিচোখে এবং যেসব বন্ধু খ্যাতির দুয়ারে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিতে দিতে একটা তীর্যক দৃষ্টি রাখছে লুপ্তপ্রায় বিরল প্রাণীদের ওপর, তাদের কারোর সাথেই আমার প্রতিযোগিতায় যাবার ইচ্ছে নেই, দরকারও নেই, কেউ কেউ ভাবে, পথ একটাই ওপরে ওঠার, স্বর্গে যাবার তারা একটা মার্গই মাত্র চেনে, অথচ জানা কথা যে অজস্র পথ আছে নানাদিকে ছড়ানো ছিটানো, ‘ভিন্নপথে যাত্রা করে শাস্ত্র মেলে একস্থান’, এইকথা বাংলার লোকধর্মও বলে, অবশ্য পতনের পথ একটাই, নিষিদ্ধ ফলভক্ষণ, বর্ণে-গন্ধে লোভনীয় সে ফলের দিকে রসনাপূজারীদের বেপরোয়া গতিবিধি দেখে, সঙ্গত হাসিটা থামাতে আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে থাকি, অস্পৃশ্যতাবাদী ব্রাহ্মণ ও নিষ্ঠাবান লোভীদের সাথে একত্রে পথচলা বড়ো ঝামেলার, এদের একদল মাথার ওপর দিয়ে চিল উড়ে গেলে ভাবে জঙ্গিবিমান, আরেকদল শূকরের মতো নাক ডুবিয়ে ড্রেন থেকে উঠিয়ে আনে বর্জ্যবাহার, এদের কারোর সাথেই, জেনেশুনে, চা-পানকালীন খণ্ড কোনো বচসায়ও আমি আর রাজি নই, ওরা ওদের মতো থাকুক, একটা পিঁপড়েও কেননা সমান দরকারি এই ইকোসিস্টেমে

‘যাহা সত্য, তাহা সুন্দর, তারেই বাসো ভালো’, এই মন্ত্র আমি বরাবরই জানি, তবে মঞ্চে চরিত্রমুখে বিশেষ পরিবেশে এ কথা শুনলে পরে নারী হলেও তাকে ‘প্রেরিত পুরুষ’ বলে মনে হয় আমার, সমাজেতিহাস বিষয়ে যৎপরোনাস্তি জানাশোনা, ‘প্রেরিত নারী’র স্থলে ‘প্রেরিত পুরুষ’-বন্ধটিই এখানে অনুমোদন করে কিঞ্চিৎ সমালোচনাসহ, বন্ধটি হরিচরণে নেই, কোনো পয়দাদেশই কেননা বর্ণিত নয় নারী পয়গম্বরের মুখে, ঈশ্বরও অঙ্কিত নানা পুরুষের রূপে, যেহেতু ধর্মপুরাণ বড়োবেশি পুরুষতান্ত্রিক, তবে কথা সেখানে নয়, আমি ‘বিনোদিনী’ দেখতে গেছি মানে কিন্তু নয় শুধু নটী বিনোদিনী, আমার কলাবেচার অধিকারের প্রতি করা উপেক্ষাপ্রয়াসটুকু মনে থেকে যাবে, গিফট মানে শুধু শুধু বস্তুভাবই নয়, বিনা মনোত্তাপে ওটা বোরো ধানের চিটা

মাসোহারা একটা বাতিঘর, কর্মজীবীদের, ওদিকে তাকিয়ে সংসার সমুদ্রে ভাসা নাবিকেরা, বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে ভি চলে, দায় ও মাল কীভাবে খালাস হবে তার নকশাপত্র আঁকে, আমার মতোদের ঠিক মাঠে মারা যেতে হবে, হঠাৎ সুনামি এসে ভেঙে গেলে বাতিঘর, ঘটিবাটি নিয়ে ঠিক ভেসে যেতে হবে, ভাসাটা চিরকালই মজাদার বটে, ভয় যত মোহনার পাকচক্রটিকে, যে দায়গুলো আমার পড়ে আছে নিজের ও অন্যের কাছে, সেসবের প্রেক্ষিত মনে এলে হঠাৎই নিজেকে খুব হিজড়া হিজড়া লাগে, ভাবি যে যতদূর নাগাল মেলে ওইদিকে, ততবড়ো ক্রসচিহ্ন এঁকে এক, চোখ দু’টো মুদে রাখি চুপে, কিন্তু ‘অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না’ মনে হয়ে যাওয়ায়, ক্রসচিহ্নজনিত ডিজেস্টারের থেকে এ যাত্রা প্রাণে রক্ষা পাই, এসব হলো গিয়ে লোকশিক্ষা, প্রয়োজনীয় খুব, তৃতীয় শ্রেণির অঙ্ক শিক্ষকের মতো, রামধনু দেখে বেড়াবার বেলায়ও, বিকেলে, আঙিনায় পেয়ে বলে বসে, হারে, তেরর কোঠার নামতাটা শিখেছিস বাছা! স্থানকালপাত্র সম্পর্কিত সাপেক্ষ জ্ঞানে খানিকটা ঘাটতি আছে মনে হলেও, লোকশিক্ষা প্রায়শই কাজে দেয়, ইনস্ট্যান্ট

সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাতে আমি আনন্দে জাগি, লিখিপড়ি, পেছনে বাজতে থাকে মৃদুসুর, ভোরকোমলা, ফিল্মে বুঁদ হয়ে থাকি, কখনো বা বন্ধুদের কল দেই, এ আনন্দের হাত-পা কেমন যারা বুঝতে পারে, তাদের সংখ্যা দেখি ক্রমশই বাড়ছে, অথচ আমার ডি-জুস প্যাকেজ নেই, দুরু দুরু বুকে তাই কনভারসেসন পিছলে যায় রঙ ইন্টারপ্রিটেশনের দিকে, গাঁটের পয়সা খুইয়ে যেদিকে যাওয়া একেবারে অর্থহীন, মনোমতো প্রতিমা নেই, নতুন ছবিটবি খেলে না সে তীর্থে, জাগে না ছবিকল্পও, ঘুমার্দ্র যারা স্কুল ছেড়ে গেছে, কণ্ঠে ক্লান্তিভার, তাদের মায়া কাটিয়ে উঠি ডিফেন্সি বাঁশিতে, অন্ধকারকে ওরা থরথর কাঁপিয়ে দেয়, মনে হয় সবাই কখনো যায় না ছেড়ে চলে, হাইবারনেশন থেকে জেগে উঠে কেউ কেউ খোঁজ নেয়, খবরও তো, কাচ্চাবাচ্চা হলো কি না কোনো, কিংবা, এবারে ওইদিকে এডিসের ধারাওড়া কেমন, পাঁচতলায় খুব একটা মশা নেই বলে আমরা শঙ্কামুক্ত বেশ, আনন্দিতও, তবু এডিস কী এডিস নয়, তা আমরা কেমনে বুঝব গো, যদি দুয়েকটা থাকেও, নিরাপদে থাকতে আমরা লেবু বা বেলির টবে খুব একটা জমতে দেই না পানি, ডেঙ্গু কী ভয়ানক চিজ সেটা সুচাঘাত খেতে খেতে বছর চারেক থেকে খানিকটা বুঝি, ওটারই এক স্বচ্ছ স্মারক, তুমি তো জান, বহন করছি আজো বেদনাভিঘাতী

ভররাতে সহসা ফুরালে সিগারেট, তড়িঘড়ি ছাদে যাই, গিয়ে হাতেকলমে, আসলে চোখেকানে, আমাকে বোঝাই যে মুদি দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে আজকের মতো, রাস্তাঘাট অন্ধকার, পাঁচতলা থেকে নামাওঠার শব্দে এখন, গোটাবাড়ি, বালিশ থেকে মাথা তুলে খরগোশের মতো উৎকর্ণ হয়ে যাবে, তাতে মন বুঝ মানে, মনে মনে মনকলা খেতে মন রাজি হয়, খুশি হয়ে ওকে আমি নিয়ে আসি ঘরে, ফ্রিজ খুলে বলি, পানি ঢালো যত পার গলায়, বস্তু বদলে হয় মানুষ বদল, কিন্তু তোমার মনের বদল আমি কিছুতে পারি নি ঘটাতে বন্ধু, আমাকে যদি একদলা বস্তুই ভাবো, আমার বদলে তবে মনের বদল তোমার হতে পারে ভাবি, এটি হলে মনে হয় নানাদিকে এই আমার এক্সপোজার বেড়ে যাবে আরো

তুঁতনির্ভর গুটিপোকা থেকে প্রাপ্ত ধারণারও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহার সম্ভব

লিখতে শুরু করবার প্রস্তুতিপর্ব

শুধু তো ছিঁড়বে বল, কী বাল ছিঁড়বে তুমি ছিঁড়েই দেখাও, লিখ রূঢ় অ্যান্টিক অথবা আলোকপুচ্ছ, বীরোচিত জেগেছিল আকাশতল্লাটে যেই সৌর-রহস্য, কিংবা লিখ গানাবেশ, অননুমোদিতেসু মৌসুমী ধারা, বুড্ডিস্ট চান্টস, দুপুরের বটগাছ আর তার ঝুরি, উইন্ডজুড়ে ভেসে আসা চৌরাশিয়াফুল, আমরা দেখেছি কত লালনের সুরমগ্ন ঘাটে-নেমে-জলখাওয়া সাধুসন্ত লোপ, ধানের খেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোদেদের গলা কেটে নদীজল লাল করে দেয়া, এসব তো লিখতে পার-- কষ্টকল্পনার শিল্পক্ষতি, ভ্রমণের মধু ভ্রমণের বিষ, পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা, আমাকে আর ছোঁবে-না নির্দেশ, চাপাতির কোপ, গুলেলায়লা আতরের ঘ্রাণ, তালেবানি বিপ্লব আর গেলাসে গেলাসে উপচে ওঠা ভেট সিক্সটিনাইন, লিখ শনির আখড়া পাড়ায় আরেকটা কানসাটের জেগে ওঠা, লিখ ধর্ষিত রাজনীতি ও রাজার নীতিতে ফলা উফশী মিথ্যার দাহে দেশজুড়ে নেমে আসা মনন-কলূষ, নগরবেশ্যার উৎকট সাজ কিংবা রাজাকারতন্ত্রপুরে বিটের তালে তালে গণধর্ষণ খেলার কথাও চাইলে লিখা যেতে পারে

কী লিখতে চাও কিছুই বল না যদি মোড়ের মস্তান লিখ, লিখ র‌্যাব-কোবরা-চিতা কিংবা পাষণ্ড পুলিশ, ফিকশনের নতুন আঙ্গিক ক্রসফায়ার নিয়ে লিখ, লিখ অকার্যকর সংসদ, মিডিয়া বুজরুকি, সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে টাকা করা, লিখ সংলাপ নামের ছিলা কলা, গাড়িহীন রাজপথে হরতালের সাফল্য-আফল্য গোনা, কুটিরশিল্পের ব্যাপক উন্নতি আর যখন যেখানে খুশি সিরিজ বোমার খেল, ঢলাঢলি ঢেলাঢেলি করে সঙ্গীকে ল্যাং মারা, লিখ কামে-প্রেমে দ্বন্দ্ব নিরসনে ট্রাক ট্রাক এ.কে-ফরটিসেভেন, পেটেন্ট কারণে লিখ বীজাভাবে ভুখা সব কৃষকের চোখে নামা জলকথা, চুরমার এথনোবোটানি আর এলিয়েন স্পিসিসের মনোকালচার, গরুদের পেটেচোখে মায়া, জিএমও’র রামচোদন আজ দেশে দেশে, মানুষ মেরে লিখ কী করে রক্ষিতে হয় বায়োডাইভারসিটি, সেবাবাণিজ্য লিখ ওতপাতা বহুজাতিকের নখদন্তহাতে, ইকোলজের দিকে চুলওড়া রভসে তবু বউ নিয়ে ঘণ্টায় আশি কিলো রান, হেলমেটে তাড়া খাওয়া বাতাসের দৌড়ের ধ্বনি, যেন শ্মশানে মাথার খুলি শরৎবাবুর দেখা, হরষে এগিয়ে যাও সন্ধ্যা হয়-হয় সময়ের ঠাণ্ডা-লাল সূর্যকুসুমের পেট থেকে নেমে আসা কবিতার উটকো চরণ তুমি ধরে বস

লিখবে কি গাঁজার ঠেক নাকি কমে আসা পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস, আধপোড়া মোমের দানিতে সিংহচিহ্নিত কোনো আসন বানাতে সিংহীর দু’চারিটি কেশের স্খলন, যুক্তির লাশে চড়ে ঠোঁটেমুখে চোপা লিখ, হেলমেট হোল্ডারে ঝোলা দিনকার কাঁচাহাট ছোটমাছ, আগুন লাগানো দামে আলুপটলটমেটোসজনেলাউ, জোটের চোটে পকেটের তলাঅব্দি টান, ‘ভাইসব, আমরা এনেছি দেশে লাখো লাখো কুমিরের ছানা, কেটে শুকনো শত খাল’, প্রতিদিন দেহের ছাল বাকল ছিঁড়ে একনম্বর গিয়ারে তবু ঘরে ফেরা, পরাজিতের, ঘরের বাইরে কোনো ফুটপাতে সদা মুখ ভার করা নিত্যব্যর্থ ত্যাগী মন, নমিত-দমিত

কী লিখতে চাও, লিখতে কী সাহসই বা কর, কিছুই তো লিখা হয় নি তোমার, যা খুশি লিখতে পার, যেকোনো কিছুতে আজ যেকোনো কিছুটিই লিখা যেতে পারে, পালাতেই চাও যদি পাঁচদিন আগে দেখা লিখ তবে স্বপ্নের স্কেলেটনখানি

পাঁচদিন আগে দেখা স্বপ্ন

যেকোনো পোর্টে থামে ও চালককে বলে হিসি-দিতে-যাওয়া-যায় জাতীয় বিমানে করে উঁচু এক টিলাতে সেদিন ডজনতিরেক বালবাচ্চা নিয়ে মহাবিপদেই পড়া, বাচ্চালোগ পাইলটকে না-বলে খোদ আমাকে বলে-কয়ে গুলতি মারতে গেছিল কোন ফাঁকে, উঠতি বয়েসি এক প্রজাপতির হেটলাইটের আলোয় ঝলসে গিয়ে আমি তথ্যটা চালককে দিতে ভুলে যাই, শেষে খটরমটর করে বিমানটি শুরু করলে ওড়া, স্রেফ মানরক্ষার তাগিদে চালকব্যাটার হাতে-পায়ে ধরে আরেকটু ল্যান্ড করাতে রাজি করানো ও বালবাচ্চাদের যাহোক একটা হিল্লা করা, বিমানের আর সব যাত্রীরা ওই ভুলের দণ্ডস্বরূপ টলারেটই করল না আমাকে, ডজনের সবাইকে উঠিয়ে শুধু টিলার ওপরে একা আমাকেই রেখে গেল ফেলে

শেষে মনমরা হয়ে নিশিন্দা গাছের ছায়া ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে কামারবাড়ির কালীকৃষ্ণ বালিকার সাথে দেখা, দু’হাতে বুক চেপে অপমানকর এক কথা বলে পাশবাড়ির দেওড়িপথে সে অন্তর্হিত হলে চোখ গিয়ে থেমে যায় পুকুরের ধারে, দেখি লাল মোরগরঙা ধার দেয়া বাইকখানা আমার ভেঙেচুরে পড়ে আছে দালানও’লা বাড়িটির পিছে, কাঁদো কাঁদো মনের বেদনে আমি ঘাসে বসে পড়ি, চুল ছিঁড়ি টেনে টেনে মাথার, ভাবি, আমার জনম গেল হারাতে হারাতে-- এসব ঘটনা নিয়ে একদিন দু’চার কথা লিখতে হবে জানলে, পকেটের নোটবইয়ে স্বপ্নবৃত্তান্তের সব অনুঘটনাও জেনো টুকে রাখতাম ঠিক গল্পকারের মতো

গল্পকার যেভাবে টুকরো ইনফরমেশনগুলো টুকে রাখেন তাঁর খাতায়

সাহায্য সংস্থার ডায়েরিতে কালো কালিতে চিকন হরফে, কখনো বাংলায় কখনো ইংরেজিতে, কখনোবা রেখায়-আঁচড়ে, সুগন্ধা নদীর বাঁক কোনমুখী, হুলারহাটগামী লঞ্চের দৈর্ঘ্য, সন্ধ্যা ও দোয়ারিকা ফেরিঘাটে পাটাতন কত-- পাতায় পাতায় এতসব বিচিত্র ফুল ফল এঁকে খানিক থেমে তিনি জানালায় তাকান, হেলান দেন চেয়ার কোচের গদিতে, হাঁটুর উপরে ভাঁজ হয়ে ঝিমুতে থাকে নীলাশীষ মাখা তথ্যভারী খাতা, বাতাসের চাবুক খেয়ে চমকে উঠে সহসা লেখেন ভাঙাব্রিজ, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, তুরপুন মার্কা খাঁটি সরিষার তৈল, লেখেন ইয়েলো ড্রাগনফাই, উর্বরা আলুর আড়ৎ, এমএল অনন্ত, যেটা আটকে গেছে বালুচরে, আর জল আর সমুদ্দুর, সব, গল্পকার যেভাবে এঁকে রাখেন তার নকশাবিদ্যা দিয়ে, আমি সেভাবে জেনো কোনোদিন ধরে রাখব সবটুকু আমার চোখের জল

আমার চোখের জল

কাঁদি না বলে কাঁচা দুঃখগুলো ভিতরের অদৃশ্য আধারে ধরা থাকে, এই ‘কাঁদি না বলে সব ধরা থাকে’ জাতীয় অহংকারটা মিথ্যা রাজহাঁসের মতো, যেটা হঠাৎ ঋ লিখতে গিয়ে ফুটে ওঠে কাগজে, কখনো না-কাঁদা খুব ক্ষতিকর, বাবা মরে গেলে আমরা কাঁদি, মা মরে গেলে, ভাইবোন-আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী মরে গেলে কিংবা স্বামী, এসব মরামরি কাণ্ড দিনান্তে ঘটে না কারো, এগুলো ছাড়াও গোপনে একা একা কাঁদা ভালো, প্রায় নিয়মিত প্রত্যেকেরই কাঁদবার মতো কিছু ঘনঘটা থেকে যায়, থাকে, গোপনে ভাবলে ঠিক পাওয়া যাবে, অবশ্য বেহায়া-নিলাজের বেলা নাও থেকে পারে, দেখো, গোপনে আমি কাল কাঁদব একাকী, অশ্রু ঝরবে যেসব পবিত্রতর, শক্তিবলে জমিয়ে সেসব শক্ত করে রেখে দেব যত্নে আদরে, আমার নিজের তো কাঁদবার মেলা ইস্যু আছে, যেসব নিয়ে এমনকি একাধটা কবিতাও লিখা যেতে পারে, ভিতরের কবিজনে দেখব বলে কয়ে, এসব ভাঙন নিয়ে যখন যেমন পারে সে যেন দু’দশ কথা লিখে-টিখে রাখে

শক্ত হয়ে ওঠা চোখের একটি জল নিয়ে কবিতা

পা ফেলতেই সাপের বাহার তিড়িং বিড়িং ফণা, পা ফেলতেই নিরানন্দ চেনা জীবনযাপন, পা ফেলতেই ঘোর দংশন, নষ্ট গাজন, পা ফেলতেই ব্যাহত হয় নিজের মতো চলা, পা ফেলতেই পকেটকাটা স্বাস্থ্যহানি, পা ফেলতেই বেজার বন্ধুর লম্বাটে পা, দৌড়ানো বা, হাজার একটা পায়ের সাথে ঠোকাঠুকি, পা ফেলতেই পায়ের গায়ে দগদগে ক্ষত একটি জেগে ওঠা

জেগে ওঠা

ফের যখন জাগব তখন রোদ এসে বিছিয়ে রেখেছে দেখব চাদর, আমি তার ওপর দি’ হেঁটে হাত মুখ ধুতে যাব, বাথরুম সারব, ধূলাবালি ঝাড়ব ও বাইরে বেরুব, যখন ফিরে আসব তখন জেগে ওঠাটা কীরকম ফলপ্রসূ হলো, তার হিসেব মেলাতে কাগজে এক আঁকব জ্যামিতি আর তার ওপর ফাঁদব একা দুনিয়া কাঁপানো সেই উপপাদ্যখানি, যা কখনো পারেন নি ইউক্লিড কিংবা শিমজাতীয় শস্যবিদ্বেষী পিথাগোরিয়ান কোনো বুড়ো

পিথাগোরিয়ান শিমবিদ্বেষ

কেন এ নিষেধ পিথু, অযথা ভজনশালার গায়ে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন লাল কৌপীনখানি, যদি রেশমের মতো ঠিক টান দিলে নাই-ই খোলে সূতা, তবে এ বন্দিদশা চল ভেঙে ফেলি, চল ঘরের বাইরে যাই, গিয়ে দেখি তুঁতপাতা গুটিপোকার খাদ্য হওয়া ছাড়া লাগে কি না দরকারি আরো কোনো কাজে

প্রকৃত বীক্ষণকৌশলী হতে পারা একটি বিরল গুণ

প্রথম দৃষ্টিলগ্নে কারো কোনদিকে তাকাতে হয়-- চোখের, মুখের নাকি অন্য কোনো উপাঙ্গের নৈবেদ্যে, কখনো জানে না সে, তাকানোর কাজবাজ কখনো কোনো ব্যাকরণের নিয়ম মেনে করা হয় নি তার, যখন যেভাবে থেকেছে, মন চেয়েছে যেভাবে, সেভাবে চেয়েই এ বড়ো জগৎসংসার চিনেছে-বুঝেছে, মনে রাখতে পারে নি কারো চেহারা, মানুষের মৌলদর্শন-গুণ কীসের মানদণ্ডে নির্ধারিত হয় জানে না তা, এমনিতেই যদি খাপে-খাপে মিলে যায় তো অদৃশ্যে ছাপ পড়ে, ভোলা যায় না

যে রাতে চন্দ্রালোক তার হাত ধরে কুয়াশার বেড়াজাল ভেদ করে প্রান্তরের পথ ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল, সে চাঁদে আর এ চাঁদে বিস্তর ফারাক বলে মনে হয় তার, কখনো কোথাও কেউ দেখেছে কি না এরে বুঝতে পারে না, অন্তরাতে বাঁশবনে হেঁটে হেঁটে আলোর শয্যায় তার মনে হয়, এ বুঝি সবচে’ নতুন, একে আর দেখে নি কোথাও, সে অথবা অন্য কেউ

একবার হিয়া-পিয়া-রিয়াকে প্রথমা-দ্বিতীয়া-তৃতীয়া ভেবে রচা হয়ে গিয়েছিল অসম্ভব এক স্বপ্নসেতু, মনে পড়ে তার, মানসিক সেই চাপেই হবে হয়ত, সহসাই দিয়ে বসে সাড়া বাঁকা দৃষ্টিডাকে, একবার মাত্র বলায় রাজি হওয়া ঠিক নয় কোনো কাজে, তবু কী যেন এক টানে লাজ ভুলে সে পৌঁছে গিয়ে জ্যামে, হন্যে হয়ে খোঁজে, কিন্তু না, কোথাও কেউ নেই, সবাইকে মনে রাখতে যে পারে না সে, তখন তা বোঝা যায়, বস্তুতই সবস্থানে তাকানো হয় নি ওদের, অথচ যতদূর মনে আসে, আবেগে ঝরঝর হয়ে সবগুলো সত্যডিম ফাটিয়ে দিয়েছিল নিজস্ব উমে, সে হেন কান্নামালা হাহাকার হয়ে অলিতে গলিতে বাজে মনের, আরেকটু ভিতরে যাবার জন্যে আকাঙ্ক্ষা-আকুলতার তবু শেষ নেই মানুষের

ওটা ছিল নিতান্তই এক সহজ সমর্পণ, বুঝতে পারে সে, আবেগ তখন উছলে উঠেছিল দিগ্বিদিকে, তার তখন মূর্ছা যাবার দশা, জগৎ বদলে যায় যেন, দিব্যি চলাফেরায় এ তার অন্যরকম এক মূর্ছানুভূতি, সবাই যেরকম পারে না, পারে কেউ কেউ, কিন্তু কী নির্মম যে ওই প্রাণকে আরেকদিন সে না-ও চিনতে পারে, ভিড়ের হৃদয়ে বেশ লজ্জার সঞ্চার হবে যদি নাই-ই ঠিক চিনতে পারে, ভাবে সে

চোখজোড়া নাকি জগৎ মাতারি তার, ফস্কায় না কোনো খণ্ড সুন্দরও, লোকমুখে এসব রটে যাবার পর কার্যত যার-তার-দিকে আর ঠিক চোখে তাকানোই হয় নি, সত্যিই যদি কেউ বাণে পড়ে বসে, কী করে সামলাবে সব, শেষমেষ দুর্বল স্বপ্নে সবকিছু জানতে-বুঝতে নিজে হয়ে ওঠে অবদমনজনিত এক পর্বতারোহী, সে তখন এত উঁচুতে যে সবাই একসময় ফিরে যায়, এমনকি দেখে বহুবল্লভারাও পশ্চাদ্দেশ দেখাতে শুরু করেছে, শেষে জানা কথা ওরাও ফেরাবে তাকে

কল্পনার মতো সত্য এ ব্যাকুল রাতে সে কি তবে আরেকবার পথে বেরুবে কুয়াশার মাথাল পরে, প্রান্তরে কড়ুই পাতার মতো ছ’ড়ে থাকা গানগুলো কুড়িয়ে বাড়িয়ে কি আরো কিছু বাগান সাজাবে, এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জবাব খুঁজে পাচ্ছে না যখন, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় রাগান্বিত লালচোখ কৃষ্ণাঙ্গ চন্দ্রমুখী, ছাদের নিচে ভৌতিক স্বর তার, বলে-- ‘আমাকে তুমি চেন না!’, আকস্মিকতায় কুঁকড়ে গেল সে, ফচকে গেল, চিনবে কী, তার চোখের দিকে তাকাতেই পারে না, তাকাতেই পারে না