Saturday 16 February 2008

আ ফ্রেন্ডলি-বোম্বিং অথবা প্রদর্শনীতাঁবুতে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছারা খুব মূর্ত হয়ে ওঠে

নয়দিক ফাঁকা একটা ঘাসে-মোড়া মাঠ, তার ভিতরে বেশ কায়দা করে তাঁবু খাটানো, বিশালায়তনের তালব্য-শ বর্ণাকৃতির এই তাঁবুটির দু’টোমাত্র দরজা, ‘শ’ বর্ণের লিখনশৈলীর সূচনাবিন্দুতে একটি, অপরটি শেষমোড়ে, তাঁবুর প্রবেশ দরজায় মস্ত এক খুঁটির সাথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইউএন ড্রেসে কোফি আনান দাঁড়ানো, কালো মুখটা তার অপমানে আরো কালো, মুখের দিকে তীর আঁকা একটা স্টিকারে লেখা অভাজনের যেকোনো গালে সজোরে একটা চড় কষে ভিতরে ঢুকুন

বিনা টিকিটে উপভোগ্য এই লাইভ শো বা জান্তব প্রদর্শনী সম্পর্কে বিশেষ জানাজানি হয়ে যাওয়ায় ভোর হতে-না-হতেই মাঠ লোকে লোকারণ্য, তবু কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো, প্রদর্শনীতাঁবুয় দর্শনার্থীদের প্রবেশ সূচিত হলো সকাল আটটায়, প্রথমজন নির্দেশমতো আনানের কৃষ্ণাননে দশাসই একটা চড় কষে ঢুকে গেল ভিতরে, প্যাসেজের শেষবিন্দুতে অপরিশোধিত রেঁঢ়ির তেলভর্তি একটা মস্ত পিঁপে ও প্রমাণ সাইজের একটি ড্রপার ল করল সে, তার ওপরে সাঁটানো স্টিকারে লেখা আমাদের দু’জনের পাছায় তেল দিন, সে দেখল ‘শ’-এর দুই ভিন্ন গোলায়তনে পরস্পরের দিকে পিঠ করে দাঁড়ানো আছে বুশ ও ব্লেয়ার, দু’জনেরই হাত-পা বাঁধা, পোশাক-আশাক স্বাভাবিক, তবে দু’জনেরই পশ্চাদ্দেশ বাজার অর্থনীতির মতো মুক্ত, নির্দেশমতো ড্রপারে তেল নিয়ে লোকটা আধাআধি করে দু’জনের পাছায় লাগাল, বুশ বা ব্লেয়ার কারো মুখেই কোনো রা নেই, বিষণ্ন, তারপর এদিকে যান স্টিকার অনুসরণ করে এগিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে লম্বালম্বি প্যাসেজে পড়তেই সে দেখল পাঁচভাগে গোছানো যুদ্ধসমর্থক দেশসমূহের রঙচঙে মানচিত্র, প্রথমভাগে আমেরিকার প্রতি উৎকোচে কাত হওয়া দেশ আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, চেক রিপাবলিক, স্লোভাকিয়া, কলাম্বিয়া, আলসালভেদর, নিকারাগুয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, পোলান্ড, রুমানিয়া ও মেসিডোনিয়া, দ্বিতীয়ভাগে ধমকে জব্দ দেশ ডেনমার্ক, তৃতীয়ভাগে অন্ধ সমর্থক দেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ড ও আইসল্যান্ড, চতুর্থভাগে আমেরিকার সাথে খাতির থাকা ভালো-- এই নীতির ধারক দেশ তুরস্ক ও হাঙ্গেরি এবং পঞ্চমভাগে মুখে এক তো কর্মে আরেক-- এই নীতির ভ্রাতৃঘাতী দেশ কাতার, কুয়েত, সৌদিআরব, মিসর, জর্ডান, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাছেই একটি বড় কালির পাত্র ও ব্রাশ রাখা এবং স্টিকারে লেখা যে কয়টি মানচিত্রে ইচ্ছে কালি লেপে দিন, লোকটি সাবেক সোভিয়েটের অঙ্গরাজ্যগুলো বাদ দিয়ে সবগুলো মানচিত্রেই অল্প আঁচে কালি লাগাল, কিন্তু কোনো তালিকায়ই ইসরায়েলকে না পেয়ে নাখোশ হলো সে, মানচিত্রগুলোর শেষে একটা ছোট্ট টেবিলে মন্তব্য খাতা পেয়ে সে আয়োজকদের উদ্দেশে লিখল, 'আপনাদের অবশ্যই জানা থাকা দরকার যে, যুক্তরাষ্ট্রের টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে যাবার সম্ভাবনার কথা জেনে ইসরায়েল ইতোমধ্যে তাদের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি ইটাল্ড ডেকয় ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের চুক্তি করেছে, কাজেই সত্বর ইসরায়েলের মানচিত্রটিও এখানে সংযুক্ত করুন', বেরোতে গিয়ে লোকটি দেখল বাহির পথের একটি খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়ানো ভয়ানকরকম বিধ্বস্ত ও এলোমেলো সাদ্দাম, স্টিকারে লেখা আমাকে চুমু কিংবা থুথু দিয়ে কেটে পড়ুন, সাদ্দাম একনায়ক হলেও দেশপ্রেমিক, সে তার নাগরিকদের মাথাপিছু মাসিক মাত্র ১৩ টাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির রেশন খাওয়াত এবং পূর্বের দাপুটে সাদ্দাম মার্কিনি প্যাদানিতে অধুনা সাংঘাতিক কাবু ও নীরিহ, দেখে, লোকটি তাকে চুমুই দিল এবং একটা দারুণ মজার খেলা খেলে বেরোল এরকম একটা অভিব্যক্তি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল

শান্তিপূর্ণভাবে সারাদিনই প্রদর্শনীটি চলল, আশ্চর্যের ব্যাপার যে দর্শকদের প্রত্যেকেই হাসতে হাসতে বেরোল, তবে সাদ্দামের ক্ষেত্রে দর্শনার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করল, কেউ থুথু দিল তো কেউ চুমু, আবার কেউবা নির্দেশ অমান্য করে মাথার উঁকুন বেছে দিল কিংবা দিল চুমু-থুথু দু’টোই, লক্ষণীয় যে সকল দর্শনার্থীই সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনীস্থল ত্যাগ করল, বাংলাদেশে এরকম ঘটনা বিরল, এ দেশে অযথাই জটলা করে লোকে, কাজ শেষ হলেও যায় না, কিন্তু এ প্রদর্শনী থেকে লোক তাড়াতে র‌্যাব-পুলিশ-চৌকিদারের একদম দরকার হলো না, এমনিতেই সব ফকফকা, সকলেই নিয়ম-নীতি মানছিল, কারোর অধিকারেই কেউ বাঁ’হাত দিচ্ছিল না, কাজেই কোনো জ্যামও লাগছিল না কোথাও

সন্ধ্যার ঠিক প্রাকক্ষণে, ভিড় যখন অনেকটাই কম, তখন এল শেরোয়ানি ও কালো চশমাপরিহিত, আনাভিলম্বিত দাড়ি, দীর্ঘ ও সুদর্শন এক ঝোলাধারী পুরুষ, সম্ভবত আয়োজনটা তার ভালো লেগে থাকবে, এজন্য সে মুচকি হাসল খানিক এবং কালবিলম্ব না করে প্রবেশপথের স্টিকার অনুসরণ করে হাতটা ঘুরিয়ে আজদাহা একটা চড় কষতেই আ.আ. করে আনান সাহেব ঘাড় ছেড়ে দিল, কেউ এই খুনের ঘটনাটা দেখে ফেলল কি না, পেছনে তাকিয়ে তা যাচাই করে কাউকে না পেয়ে সে বাঁ’হাতে চশমাটা খুলে ফেলল, অমনি চেনা গেল যে লোকটা আরবীয় বংশোদ্ভূত ওসামা বিন লাদেন, সে তারপর ঢুকে গেল ভিতরে, আড়াল পেয়ে এবার সে স্টিকার অনুসরণ না করে ঝোলা হাতড়ে বের করে আনল হাতদেড়েক দীর্ঘ মসৃণ দু’টি লাঠি এবং ইতোমধ্যে তেলাধিক্যে ফুল্ল বুশ-ব্লেয়ারের শ্বেতশুভ্র পাছাদ্বয়ে সপাৎ করে ঢুকিয়ে চালাল আচ্ছারকম ডালঘুঁটনি, এতে বু.বু.-বে.বে. শীৎকার করে দু’জনই একে একে পটল তুলল, লাদেন খুশিতে আটখানা হয়ে ডানে মোড় ঘুরে মানচিত্রের মজাদার আয়োজন দেখে খুবই পুলকিত বোধ করল এবং ব্রাশে বেশি করে কালি নিয়ে আফগানিস্তানের কেবল ‘স্তান’ বা ‘স্থান’ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সবকটি মানচিত্রেরই অস্তিত্ব লুপ্ত করে দিল, মন্তব্য খাতায় সে লিখল, বেড়ে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছ বাহে, তোমাদের আল কায়েদার সভ্য করে নিলাম : বিন লাদেন, এরপরে হাঁটল সে, এন্ডিংয়ে কাতর সাদ্দামকে দেখে লাদেন এমন আনন্দিত হলো যে নির্দেশমতো শুধু চুমু দিয়েই সে ক্ষান্ত হলো না, বাঁ’হাতে জাপটে ধরে বুকে-মুখে ঘষে দিতে থাকল তার দীর্ঘ নাসা এবং ডান হাতে চাপড়ে দিতে থাকল সাদ্দামের সহনশীল পিঠ, তার কাঁধবাহী ঝোলাটা-যে দু’জনের মাঝখানে পড়ে গিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হতে চলেছে, আবেগের প্রাবল্যে তা বোঝার সাধ্যটাই হারিয়ে ফেলল সে, ঝোলাটাকে সে ভাবল সাদ্দামের ভুড়ি, কাজেই চাপ, চাপ, মনের মাধুরী মিশিয়ে চাপ, কাণ্ডটা ঘটল ঠিক তখনই, হঠাৎই শোনা গেল বিস্ফোরণের শব্দ, আ ফ্রেন্ডলি-বোম্বিং, মালটা ছিল ঝোলার ভিতরেই, তাজা, মুহূর্তে দু’জনই খানখান, ছিন্নভিন্ন, তুলোধুনা, এখানে মাথা তো হাত-পা গজ বিশেক দূরে, মাঠের গা ঘেঁষে থাকা শিশুগাছের পাতাগুলো বোম্বিংয়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ ধরে কাঁপতে থাকল, গোধূলির আলো-আঁধারিতে পশ্চিমাকাশে তখন দেখা গেল এক দঙ্গল হিংস্র শকুন, যারা এদিকেই ধেয়ে আসছে

No comments: