Saturday 16 February 2008

বলাবলির কেন্দ্রাতিগ মোটিফই বলনকেতার পথপ্রদর্শক

কথাগুলো বারকতক বলা হয়েছে বলে অন্য কোনো শব্দসংগঠনে বা উপায়প্রয়োগে, বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে যা তা বোঝানো যায় কি না, এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিস্তর রাত ভোর হয়ে গেছে তার, কিন্তু খোঁজ মেলে নি। যে কারণে মাঝেমধ্যে চলাকথায়ই ভাবনাটা বলেছে। আজ বলবে না তবু, এ প্রতিজ্ঞায় পুরোমাত্রায় বদ্ধমূল হয়ে, সাদার দিকে চোখ গেঁথে কেন্দ্রের চারপাশে মনের রঙে আঁকছে এক গোলাকার বৃত্তবোধ, প্রকৃত অভিনিবেশ এখন দৃষ্টিগ্রাহ্যতায় নেই, আছে আরো দূরে ও গভীরে। মনোগ্রাহী ও নিষ্ঠ এ কালখণ্ড বয়ে নিয়ে আসতেও পারে অপ্রদেয় কোনো পুরস্কার, আনকোরা কোনো পথ, সুপথ, সে ভাবে, যে পথে সরসর করে বেরিয়ে আসবে না-বলা কথা, অকথিত অনুভূতি, নিবেদনের বৃবৃত্তান্ত।

অগণনীয় আঁধার ও তার আয়তনজনিত মূহ্যমানতা চিরে আসা আলোকের গোলকধাঁধায় বিবস্ত্র রাত অমীয় নন্দনতারল্যে ভাসমান। যে কখনো জানে না কবে শিল্পসকাশে যাবে আরূঢ় সুন্দর, সেমতো সাঁকো নেই, সেমতো খলবলানি, আলোদের, নেই ত্রাসস্তব্ধ পৃথিবীতে শান্তির ফুরসৎ।

অপেক্ষা উদ্বোধিত হয় কষ্টে সংগৃহীত কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে অপঠিত বইয়ের মতো, যেন শব্দ-বাক্যেরা ধ্বনিত হচ্ছে শুধু কর্ণে পশছে না ; বিবাহআসরে বসে ফুটফুটে সন্তান কামনার মতো, যেন মেঘ ভেঙে জল ঝরছেই শুধু মাটি ভিজছে না-- এসব উপমোৎপ্রেক্ষায় ঘন ঘন ‘মতো-যেন’ জাতীয় তুলনাবাচক শব্দ ফুড়ুৎ করে ঢুকে যাচ্ছে দেখে দমে যায় সে, কারণ বলাভঙ্গিতে কথা বললে আজকাল টানটান মানুষ হওয়া যায় না, কবি তো দূর অস্ত। কত ধরনের টানটান আভিজাত্য আজকাল বলার-লেখার, তার চে’ বেশি আর ক’জন জানে, সে তো প্রতিদিনই অনেক পাতা উলটায় কাগুজে গ্রন্থ মায় জীবনগ্রন্থের, তার নখদর্পণে আছে অনেক জনের লেখা-চলা-বলা-- উদয়, গ্রহণ ও অস্তের আহাজারি।

কখনো সে রাতকে পাহারা দেয়, গোটা শহর চষে ফেলে, পেছনে পড়ে থাকে সিফন শয্যার উম, ছবি আঁকে জ্যামিতিকে হার মানা-- কত বিচিত্র লাগে সব দেখতে-শুনতে, কত বিচিত্রই-না হওয়া উচিত। একেকটা দৃশ্যবর্ণনা যেন পথবেশ্যার ময়লা স্তনের মতো, নিযৌন শীৎকারের মতো, রাতকে ফালা ফালা করা হুক্কাহুয়ার মতো। আবারো মতোকথা চলে আসে দাঁত বের করে, বিরক্তিতে শেষে ছবি আঁকাকেই জরুরি মনে হয়ে যায়, চিঠি লেখাকে, অথচ কখনো সে ছবি আঁকে না, বস্তুত চিঠি কাল লিখলেও চলে, যতসব পলায়ন ঘোর।

একসময় মনে হয়, তার বলবার কথাই কি আসলে নেই ? বিষয়ভাবাপন্ন এই দেশে বিষয়হীনতাকে কেউ কোনোদিনই আমলে নেবে না, বলবে যাচ্ছেতাই শব্দ খেলেছে। শব্দে শব্দে জড়াজড়ি করে ধরে আছে কত যে বিষয়ের অন্তত কঙ্কাল, এ তথ্য ক’জন বের করে নেবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ? আতঙ্ক জাগে মনে, আতঙ্কে সে রুই-রুই উড়তে দেখে বাতাসে-বাতাসে বিষয়ের রেণু, এবং ভাবে, ওই উড্ডয়নম বিষয়রেণুই বস্তুত সবকিছু, যা এখনই বিষয়রূপে আছে, তাকে বিষয়ী করে তোলা কোনো কাজের কথা নয়। বিষয় ছাড়িয়ে যে বিষয়হীনতা, তার চাষাবাদের সমূহ সম্ভাবনাকে বিষয়ের এক-এক খণ্ডরূপে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সারে, বিষয় সমীপবর্তী হলে, তবেই বলা-কওয়ার থেকে যেতে পারে কোনো কার্যকর মানে।

শব্দ ভাঙে, শব্দ জোড়া লাগায়, তার সমবায়ে দেয় নতুন ছন্দনাচ। মোক্ষম বলাটা হয়ে গেলে ঠিক নড়ে ওঠে, চড়ে ওঠে, এ যে প্রাণের অধিক কেমন অন্য আরেক প্রাণ, যারা একে নাড়িয়ে চাড়িয়ে জানে, তাদের আসে অনুভূতি। আর চেয়ে দেখে একে একে সে মরে যাচ্ছে, বলতে গিয়ে যে সমূহ প্রস্তুতি, তা সেরে ঠিক বলবার মুহূর্তটি পর্যন্ত অপেক্ষায় অপেক্ষায় তার সব শুকিয়ে যায়। সে তখন মৃতবৎ হয়ে যায় এবং যা খুশি বলে, যেমন তেমন করে বলে। ওটাই তখন হয়ে ওঠে বিশিষ্ট এবং সে মৃত্যুকে জীবনের জন্য বরণ করে নেয় অনিবার্য ঘুমে।

No comments: