Saturday 16 February 2008

নদীই কলাজ্ঞানের সেরা শিক্ষক

টিনএজ যাকে বলে, সেই কাঁচা দিনেরাতে, নিজেকে সে কত যে নাগরী রূপে ভেবেছে গোপনে, কিন্তু নাগর তার দিকে কখনোই তাকায় নি প্রাণখুলে। প্রতিবিকেলে নাগরের বুকে নিজেকে আমূল সঁপে দিয়ে দিত সে চিৎসাঁতার, যদিও বেশিক্ষণ স্থায়ী হবার জো ছিল না সেটার। পাড়ে দাঁড়িয়ে ‘এবার ওঠ তো মা, অনেক হয়েছে’, কিংবা ‘লক্ষ্মী মা আমার, আবার-না ঠাণ্ডা বাঁধিয়ে বসিস, ওঠে আয় মা’ বলে বলে পাড় মাতিয়ে তুলতেন তার বিরলা জননী। আরো কত কী যে ছিল তাদের শৃঙ্গারমালায়-- সুযোগ পেলেই পা ডুবিয়ে তীরে বসে থাকা, স্পিডবোটে দূরে কোথাও ভেসে যাবার বেলায়ও পাঁচ আঙুলে জলের সাথে পরকীয় জানান রক্ষা করে চলা।

বহুবার সে চেয়েছে যে নাগর তাকে ষোলআনা গ্রহণ করুক, কিন্তু একটু একটু করে মনে রঙ লাগতে লাগতে পুরোটা রঙিন হওয়া পর্যন্তও নাগরের প্রকৃত সায় মেলে নি। নাগরীর প্রত্যাশিত সে মহান মৃত্যু হয়েছিল, পড়ন্ত যৌবনে, যখন গায়ের রঙ অনেকটাই পুড়তে লেগেছে। সেটা ছিল মায়ের বুকে মুখ গুঁজে, স্বপ্নে। বক্ষের অবারিত উম দিয়ে অভিমানী অশ্রুভেজা মেয়েকে জাপটে ধরে নিয়েই মা ক্রমশ নামছেন গিয়ে নাগরের বুকে, একটু একটু শীত বোধ হচ্ছে তার, উম থেকে সে রিমুভ হচ্ছে একে একে। এক মিশ্র অনুভূতির আচ্ছন্নতায় মুখ তুলে টু শব্দটি পর্যন্ত করে নি সে। এভাবে তলাতে তলাতে শেষে তলানিতে, চলনবিলের সাথে ল্যাপটে যাওয়া ভরাবর্ষায়। ভীষণ ঠাণ্ডায় সে শেষে জেগে গিয়ে ঠকে, কারণ জাগ্রত তাকে পরে ফিরিয়ে দিয়েছে সবে, নাগরমহলে ছিল বসন্ত যারাই।

এহেন উমশীতলতা বড়ো ইটাজঙ্গলে নেই, আছে জল-মাটি-ঘাসে, মায়াবি মফঃস্বলে। সেবার তরুণী বয়সে, ঘোর যমুনার তীরে, খোঁপায় তিনটে প্রাণকাড়া রঙিন ফুলপরা মনোরঞ্জিত সে শাদা শাড়ি। মায়ারোদ মাখা বিকেলের গা ছুঁয়ে দিতেই তার বাইরে বেরোনো, সেটা ছিল বস্তুত নিজেকে ছোঁবারই এক ধরনের লুকোনো প্রয়াস। দিনে দিনে সে যে ফুটছিল পুষ্প সমতুল হয়ে, একটু একটু করে, মোহিনী গন্ধভরা সেই দেহাধারের থই থই কল্লোলই উসকে দিয়েছিল তাকে আয়নার বদলে অন্যের চোখে তাকিয়ে অভিব্যক্তির বর্ণমালায় একবার নিজেকে পড়তে।

সেবারই প্রথম সে বোধ করে শিহরণ, জেগে উঠে কবোষ্ণ ‘আমি নারী’-বোধে, শীতনিদ্রা ভেঙে আসা ঘাসফড়িঙের মুখে ‘অবাক সুন্দর’ শুনে। আহা তার পরম আদরে পরা টিপ! আহা শিল্পযতনে আঁকা মায়াবি কাজল! জগতের সমস্ত লাজ তখন ভর করেছিল এসে তার গায়ে, মনে উষ্ণ আবেগ মজুদ, তবু কী যে এক পালাই পালাই ঘোরে পায়ে জেগে ওঠে যত অচেনা মুদ্রারা। আজ মনে হয়, ফড়িঙের নিত্য ওড়াওড়ি স্থল গহীনাঙ্গনে হলে, ঝাঁকে ঝাঁকে কামনা ঝরত বহু লতাসঙ্গমে, ডানাঅলা সেইসব দিনে।

আজ যে সে থেকেও নেই, এই আপাতমৃত্যুর ধারণাটি পেয়েছিল সে গাছপ্রেম থেকে। নাগর যেখানে বাঁক নিয়ে গেছে ইউকাট হয়ে, ফোকরে জল রেখে, তারই এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ওই শতবর্ষী গাছ। যেদিন কাটা পড়ল প্রিয় তেঁতুল, চাচার নাছোড় জেদে, পোকায় খাওয়া শ্বাসমূল দেখে ওর, কষ্ট পেয়েছিল খুব। নিগৃহীত বাতাস ও ভালোবাসার ওজনে ওর বিক্রয়মূল্য স্থির করা কিছুতে চলে নি। কিংবা ঘনআত্মীয় যে ধবল বক অথবা কাঠবিড়ালি, তাদের আশ্রয়ের মূল্যমান মূল অঙ্কে কখনোই যোজিত হয় নি। সেই হারিয়ে ফেলানোর বেদনাকে তখন কে আর থামায়, এক নাগরের বুক ছাড়া ? নিত্য নিদান তার ছিল ওই নাগরেরই বুক, আজ তার বক্ষে শুধু গনগনে চুলা।

No comments: